ডিজিটাল পরিমণ্ডলে অপরাধ ও শাস্তি

বর্তমান সময়ে সাইবার জগতটা আমাদের অন্য একটা বাস্তবতা হয়ে উঠেছে। এই সাইবার মাধ্যমে কাটানো সময়গুলোর প্রভাব জীবনে বেশি করেই অনুভূত হচ্ছে। আমাদের জীবনযাত্রা সহজ করার পাশাপাশি অপরাধীদের কার্যক্রমও সহজ হয়ে গেছে! আবার আমরা নিজেরাও অনেক সময় না জেনে, না বুঝে নানান অপরাধের শিকার হচ্ছি, আবার ক্ষেত্রবিশেষে অপরাধও করছি। একটা রাষ্ট্রে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন ও শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে কার্যকরী আইন প্রয়োগ জরুরি। তেমনি এই পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ভালো ভূমিকা রাখতে পারে।

আমরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নাম সকলে শুনলেও কোন কোন অপরাধ এই আইনের আওতায় আসবে সেগুলো অনেকেই জানিনা। অনলাইনে কোন কোন অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ আছে এবং কোনগুলো বাংলাদেশী আইনে অপরাধ সেসবও অজানাই রয়ে গেছে।

এই আইনের আওতায় থাকা গুরুত্বপূর্ণ কিছু অপরাধ এবং এর শাস্তি সম্পর্কে বিস্তারিত জানলে আমাদের জন্যে অনেক ঝামেলা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। আইন প্রদত্ত নিরাপত্তাও হবে সহজলভ্য।

উল্লেখযোগ্য সাইবার অপরাধ এবং শাস্তিসমূহ:

১। কোন ডিজিটাল তথ্যভাণ্ডারে বেআইনি প্রবেশ এবং এর ক্ষতি করা।

বেআইনি প্রবেশের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৭ বছরের জেল এবং ২৫ লক্ষ টাকা জরিমানা। ক্ষতিসাধনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের জেল এবং ১ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। এই অপরাধ আবারো করলে অনধিক ৫ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।  

২। অনলাইনে স্প্যাম মেসেজ (জাঙ্ক মেসেজ) শেয়ার করা, হ্যাকিং, কম্পিউটার ভাইরাস ছড়ানো এবং অনলাইনে আর্থিক জালিয়াতি করলে –

৬ মাস থেকে ৩ বছরের জেল এবং ২ লক্ষ থেকে ১০ লক্ষ টাকা জরিমানা করা হয়।

একই অপরাধ পুনরাবৃত্তি হলে শাস্তির পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে যাবে।

৩। মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীতের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও এসব জাতীয় বিষয়ের অবমাননা করলে বা তাতে মদদ দিলে সর্বোচ্চ ১০ বছরের জেল এবং ১ কোটি টাকা জরিমানা হতে পারে। এই অপরাধ একাধিকবার করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে।

৪। অনলাইন মাধ্যমে মিথ্যা তথ্য দিয়ে আর্থিক বা অন্য কোন সুবিধা নেয়ার জন্যে প্রতারণা এবং মিথ্যা পরিচয় বা ছদ্মবেশ ধারণ করে প্রতারণা এই দুই ক্ষেত্রেই অনধিক ৫ বছরের কারাদণ্ড এবং ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা করা হতে পারে। একই অপরাধ আবারও করলে শাস্তির মাত্রা বেড়ে ৭ বছরের জেল এবং ১০ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড হতে পারে।

৫। অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ, ব্যবহার যেমন – নাম, পিতা-মাতার নাম, জন্ম তারিখ, ফোন নাম্বার, জাতীয় পরিচয়পত্রের নাম্বার, পাসপোর্ট নাম্বার, ড্রাইভিং লাইসেন্স, জন্ম সনদ, ফিঙ্গার প্রিন্ট, ব্যাংক একাউন্ট নাম্বার, ডিএনএ প্রোফাইল বা অন্য যেকোনো পরিচয় সংক্রান্ত তথ্য ব্যবহার করা একটি সাইবার অপরাধ। এই অপরাধে অনধিক ৫ বছরের জেল এবং ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা করা হতে পারে। একই অপরাধ আবারো করলে শাস্তির পরিমাণ বেড়ে ৭ বছরের জেল এবং ১০ লক্ষ টাকা জরিমানা হতে পারে।

৬। রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা, নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করা এবং জনগণ বা এর কোনো অংশের মধ্যে ভয়ভীতি সঞ্চার করার জন্যে কোনো কম্পিউটার বা কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা ইন্টারনেট নেটওয়ার্কে বৈধ প্রবেশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে বা বে-আইনি প্রবেশ করে তাহলে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড এবং ১ কোটি টাকা জরিমানা করা হতে পারে। অপরাধে আবারও জড়িত হলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড হতে পারে।

৭। কোন ধর্মীয় গোষ্ঠীর অনুভূতিতে আঘাত করে ইচ্ছাকৃতভাবে অনলাইনে এমন তথ্য প্রচার বা মতামত প্রদান করলে সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ড এবং ১০ লক্ষ টাকা জরিমানা হতে পারে। অপরাধের পুনরাবৃত্তির ক্ষেত্রে শাস্তি বেড়ে ১০ বছরের জেল এবং ২০ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড হতে পারে।

৮। কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে।

কিংবা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে বা অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অথবা আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় তাহলে অনধিক ৭ বছরের কারাদণ্ড এবং ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা হতে পারে। এই অপরাধ পুনরাবৃত্তি করলে শাস্তির পরিমাণ বেড়ে গিয়ে ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং ১০ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড হতে পারে।

 ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় থাকা অপরাধ এবং এর শাস্তির পরিমাণ জানাই যথেষ্ট নয়। এই আইনের মাধ্যমে সঠিক নাগরিক অধিকার আদায় করে নিয়ে ব্যক্তিজীবন, ভার্চুয়াল জীবন সবখানেই নিরাপদ থাকার নিশ্চয়তা না পেলে মানুষের আস্থা কমে যাবে দিন দিন। এই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা এবং তা মেনে চলার প্রক্রিয়াটি শুরু হোক আইন সম্পর্কে জানার মাধ্যমেই!