কপিরাইট সংরক্ষণে করণীয়

ধরা যাক, আপনি বাজারে গিয়ে একটি টাকাও খরচ না করে সংসারের দরকারী সকল পণ্য নিয়ে বাড়িতে ফিরে এলেন। ব্যাপারটি ক্রেতা হিসেবে আপনার জন্য খুবই সুবিধাজনক হতে পারে। কিন্তু একজন বিক্রেতার পক্ষে এটি মোটেও সুখকর নয় যে ক্রেতা তার দোকান থেকে কোন টাকা না দিয়েই সকল পণ্য নিয়ে যাচ্ছে। এর সাথে আরেকটি উদাহরণ যোগ করা যাক। আমরা বিদেশি লেখকদের বই কিনে পড়ে থাকি। কিন্তু এই বইগুলো খুবই ব্যয়বহুল বিধায় আমরা তুলনামূলক অনেক কম দামে বইটির নকল কিনে নিয়ে আসি।

প্রথম উদাহরণটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক এবং বাস্তবে তা সম্ভব নয়। কিন্তু দ্বিতীয় উদাহরণটি আমাদের বাস্তব জীবনের সাথে সম্পর্কিত এবং হরহামেশাই এটি ঘটছে। মেধাসম্পদের ক্ষেত্রে এভাবে একজন কোন একটা পণ্য ক্রয় করে সেই পণ্যকে কপি করে অনেকের কাছে বিক্রি করে থাকে। নতুন করে এই বিক্রির কোন অংশ যিনি আসল মালিক তিনি পান না। বরং যিনি সেটার কপি বা পাইরেসি করছেন তিনি পেয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে পাইরেসি বন্ধে কার্যকর কপিরাইট আইন এই মেধাসম্পদের নিরাপত্তা দেয়।

মেধাসম্পদ, পাইরেসি এবং কপিরাইট আইন কী?

একজন কবি যে কবিতা লেখেন, শিল্পী যে গান করেন, ছবি আঁকেন বা ভাষ্কর্য নির্মাণ করেন, চলচ্চিত্রকার/নাট্যকার যে সিনেমা/নাটক তৈরি করেন সেসবই হচ্ছে তার ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি বা মেধাসম্পদ। মেধাসম্পদের বেআইনি কপি করে যদি কেউ তা বিক্রি বা ব্যবহার করে তাহলে এটি হবে পাইরেসি। এই পাইরেসি বন্ধ এবং মেধাসম্পদের নিরাপত্তা প্রদানের লক্ষ্যে প্রণয়ন করা আইনই হচ্ছে কপিরাইট আইন।

কোন বস্তুগত জিনিসের যেমন মালিকানা থাকে, তেমনই প্রতিভা ও মেধা দিয়ে তৈরি সম্পদেরও মালিকানা থাকে। কপিরাইট মানে হচ্ছে মেধাসম্পদের উপর মালিকানার স্বীকৃতি। কোন মেধাসম্পদের ব্যবহার, বিপণন বা ক্রয়-বিক্রয়ের উপর যিনি তা সৃষ্টি করলেন তার অধিকার সুরক্ষিত করে এই কপিরাইট আইন। 

বাংলাদেশে কপিরাইট আইন আছে, কিন্তু সে আইন মানার চর্চা ও প্রয়োগ না থাকায় অনেকেই এই বিষয়ে জানেন না। এই বিষয়ে তাই আমাদের জানা, মানা এবং চর্চা করা প্রয়োজন। 

কপিরাইট আইন ভঙ্গের কারণ ও ক্ষতি

কপিরাইট সংরক্ষণে বাংলাদেশে আইন থাকলেও নেই এই আইনের কার্যকর প্রয়োগ। এর মূল কারণ সম্ভবত ব্যবহারকারী এবং  উৎপাদক এই দুই দলের কারোরই কপিরাইট আইন ও আইনের প্রয়োগ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা না থাকা। সেই সাথে সাংস্কৃতিক কিছু কারণও হয়তো দায়ী। যেমন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বা জীবনে চলার পথে আমরা অন্যের কোন মেধাসম্পদ থেকে কিছু নিলে বা সরাসরি ব্যবহার করলে সেজন্য মূল মালিককে কৃতিত্ব দিতে অভ্যস্ত নই। আবার নিম্ন আয়ের দেশ হওয়ায় সকলেই মৌলিক প্রয়োজনের বাইরে বিনোদন বা বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতির জন্যে বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে সাধারণত আগ্রহী নন। আবার ডিজিটাল প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে নতুন নিরাপত্তা ব্যবস্থা বা নতুন বিপণন ব্যবস্থা তৈরি করতে না পারাও বড় একটি কারণ।  সর্বোপরি বলা যায়, এই আইন সম্পর্কে ভালোভাবে জানা এবং আইনের প্রয়োগ থাকলে মেধাসম্পদের নিরাপত্তা দেয়া অনেক সহজ হয়ে যাবে। কপিরাইট আইন ভঙ্গের কারণে সৃজনশীল মানুষদের বিপুল পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে এবং এই ক্ষতি আমাদের শিল্প-সাহিত্য-চলচ্চিত্র ইত্যাদির বিকাশের অন্তরায়। একজন লেখক বই প্রকাশ করার পর সেই বই যদি কপি করে কেউ মুনাফা করে ফেলে বা তা বিনামূল্যে সবার কাছে ছড়িয়ে দেয় তাহলে লেখক আর নতুন কোন বই লিখে বিক্রির আশাই হয়তো করবেন না। এভাবেই চলচ্চিত্র নির্মাতা, সঙ্গীত শিল্পী বা এ ধরনের যে কোন শিল্পই পাইরেসির কারণে ক্ষতির শিকার হচ্ছে।

বাংলাদেশে কপিরাইট আইন ও কপিরাইট সংরক্ষণ করার উপায় কী?

বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে প্রথম কপিরাইট আইন করা হয়। এরপর ২০০০ সাল এবং ২০০৫ সালে এই আইন পরিবর্তন করা হয়। সর্বশেষ পরিমার্জন করা হয় ২০১৮ সালে।

বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদগুলো পেটেন্ট অফিস থেকে নিজ নামে পেটেন্ট করে নিতে হয়। পেটেন্ট করা মানে হচ্ছে সরকারি রেজিস্ট্রেশন করে নিজ নামে এই সম্পদের সামগ্রিক অধিকারের স্বীকৃতি নেয়া। পরে যদি অন্য কেউ এটি ব্যবহার করে তাহলে সে মূল নির্মাতাকে কৃতিত্ব দিবে এবং ক্ষেত্রবিশেষে মুনাফার ভাগ দিবে।

কপিরাইট সংরক্ষণে এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে -

-      যেকোন মেধাসম্পদ তৈরির পর তা সরকারি কপিরাইট অফিসে রেজিস্ট্রেশন বা তালিকাভুক্ত করতে হবে। এর মাধ্যমে যিনি তা তৈরি করেছেন তার নামে সম্পদটির স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত হয় এবং এর ভিত্তিতে ভবিষ্যতে কপিরাইট দাবি করা যাবে। তাই রেজিস্ট্রেশন না করলে কোন মেধাসম্পদের কপিরাইট দাবি করে এর পাইরেসির বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া যাবে না।

-      পাইরেসি হলে উপযুক্ত প্রমাণসহ লিখিত অভিযোগ করতে হবে।

-      সবার মধ্যে কপিরাইটের ব্যাপারে যথাযথ সচেতনতা তৈরি করতে হবে।

-      সকল ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ কঠোর করতে হবে।